Saturday, May 28, 2016

সন্ধ্যাবেলা

সন্ধ্যাবেলা একটা কেমন যেন সময়। বেশ দিন ছিল। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ টুপ করে সূর্যটা ডুবে যায়। লাল আলোটা ছড়ায় বটে তবে কেমন মন কেমন করা। খুশির থেকে মনমরা ভাবটা যেন একটু বেশি। কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব। এখুনি চলে যাবে। ভাল সিনেমার শেষে যেমনটা হয় না। মনে হয় আর একটু হলে হত কিন্তু ঠিক শেষ হয়েই যাবে। একটা ধরতে না পারা একটা পিছলে যাওয়া অনুভূতি। ঠিক যেন আইস্ক্রিম খাওয়ার মত। এই বুঝি গলে জল হয়ে যায়। তারপর কালসন্ধ্যাবেলা। আরো অবশ করা। শুনেছি এই কালসন্ধ্যাবেলাতেই নাকি হিরণ্যকশিপু ঢলে পড়েছিল মৃত্যুর কোলে। একটা না আলো না ছায়া ভাব। আলো ভাল, আঁধারও ভাল। কিন্তু এই আলো আঁধারিটা ঠিক যেন সওয়া যায় না। 
ছোটবেলায় যখন বিকেলে খেলতে যেতাম তখন সন্ধ্যাবেলা ছিল ঘর ফিরে আসার সময়। অনেক বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ আসত। বাড়ি ফিরে দেখতাম মা সন্ধ্যা দিচ্ছে মানে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে তুলসীতলায়। খেলার পরে বাধ্যতামূলক ছিল হাত পা ধুয়ে বাড়ি ঢোকা। বাডির বড়রা নজর রাখতো। হাত পা ধুলাম কি না। 
শীতকালে সন্ধ্যা বড় তাড়াতাড়ি হয়ে যেত। খেলার সময়টা অনেক কমে যেত। তার উপর যেই খেলা শেষ করতাম শীতটা যেন হঠাৎ চেপে বসত। মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতো সোয়েটার নিয়ে। ছোটবেলা মানে অনেক ছোটবেলা, যখনও আমি হোস্টেলে যাই নি। 
শীতকালে বোরো ধান কাটা হত। বোরো ধানে নাকি অনেক কীটনাসক থাকে। তার উপর বোরো ধানে অনেক বড় বড় রোঁয়া থাকত। বিকেলবেলায় একটা প্রধান খেলা ছিল ধানের জাঙ্গির / গাদার (এটার আর বঙ্গানুবাদ করতে পারলাম না, যে জানে সে জানে) উপর উঠে লাফালাফি করা। ফলে অবধারিতভাবে যখন খেলা শেষ হত তখন বোঝা মুস্কিল যে খেলে ফিরছি কি রণক্ষেত্র থেকে ফিরছি। সারা হাত পা কেটে যেত খড়ের রোঁয়ার। তা থেকে রক্ত বের হত। তখন কি যে ম্যাজিক করা থাকত জানি না, যন্ত্রণার কোন বালাই থাকত না। থুড়ি, যন্ত্রনা হত যখন পড়তে বসতাম। তখন রাজ্যের যন্ত্রনা। তার উপর মায়ের বকুনি। আশ্চর্যের ব্যাপার পরের দিন আবার যে কে সেই। সেই খড়ের গাদা, সেই লাফালাফি সেই ধুল্‌ সেই কাকুর/বাবার অবিচ্ছিন্ন বকুনি। খড়ের গাদা আমাদের কাছে খেলা হলেও বড়দের কাছে কাজ। 
যাই হোক বিকেলবেলা বলতে বসিনি এখন, বসেছি সন্ধ্যাবেলা বলতে। যেই বিকেলটা শেষ হয়ে যেত ঝুপ করে নেমে আসত অন্ধকার। হঠাত সব চুপচাপ। ঘর ঢোকার সময় মন্দিরে পুজো হত। তার প্রসাদের জন্য অপেক্ষা করতাম। 
সেই কাঁসর ঘন্টা আজও বাজে। সেই প্রদীপ এখনও জ্বলে। সেই প্রসাদ আজও বিলি হয়, সেটা নিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হুটোপাটি করে। লুকিয়ে লুকিয়ে দুবার প্রসাদ নেবার চেষ্টা চালায়। বিশেষ করে শীতকালে (না গ্রীষ্মকালে??) স্বর্গবাতি জ্বালানো হয়। অনেক উঁচুতে একটা বাঁশের উপর একটা প্রদীপ জ্বালানো হয়, একটা লাল শালুর ঘরে, যেটাকে স্বর্গবাতি বলে। কাঁসর ঘন্টা কে বাজাবে সেই নিয়ে ঝগড়া হয় আজও , মনে হয়, মানে তাই তো হওয়া উচিৎ। বামুন-ঠাকুরের পুজো কখন শেষ হবে তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা, শাঁখ বাজলেই শান্তিরজল ছেটানো। সেই শান্তিরজল যাতে পায়ে না লাগে তার জন্য পা গুটিয়ে বসা, মায়ের আঁচল দিয়ে পা ঢেকে নেওয়া, পাশের সবার পা ঢেকে দেওয়া, সবই হয় - তাই তো মনে হয়। 
সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ সূর্য ডুবে যাওয়া - আবার তারই মাঝে কত কাজ। সবই সারতে হয় দ্রুত। না হলে অন্ধকার হয়ে যাবে। 
কতদিন হয়ে গেল সূর্য ডোবার পর অন্ধকার দেখি নি। সন্ধ্যার সেই মনকেমন করা ভাব ল্যাবরাটরির নিরন্তর আলোয় জায়গা খুঁজে পায় না। তবু হঠাৎ জানালার ফাঁক দিয়ে সেই লাল রংটা দেখলে মাঝে মাঝে বুকের ভেতর কোথাও যেন কি একটা মাথা আলোআঁধারি আবছা আবছা ভেসে ওঠে। হৃদগতিটা একটু ওঠানামা শুরু করে। যেমন এখন করছে।