Monday, December 11, 2017

আবছায়া

ডিসেম্বর মাস ২০১৭। সকাল ৬ঃ৫৪। তাপমাত্রা ঋণাত্মক ১২ ডিগ্রী। মানে শীতকালে কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হিমাঙ্ক থেকে যত উপরে থাকে এখানে ঠিক ততটাই নিচে। এটা বর্ণনা করা খুবএকটা সহজ কাজ নয়। শুধুই অনুভব করার।

 বাইরে হিমেল, থুড়ি, হিমেলতর হাওয়ার প্রবাহ অবশ্য আমার জীবনে খুব একটা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে না। ঘরের মধ্যে ঘর গরম করার জন্য ব্যবস্থা আছে। আমাকে শুধু একটা সুইচেই চাপ দিতে হয়। সেটা থেকে যে যন্ত্র চালু হয় তা একটা পাইপলাইনের জলকে গরম করে। সেই পাইপ লাইন ঘরের মেঝের নিচে জালকাকারে বিছানো আছে। গরম জল সেই জালের মধ্য দিয়ে গেলে ঘরের মেঝে গরম হয়ে যায় আর সেই সাথে গোটা ঘর। কি অদভুত ভাবনা। কি সরল অথচ কি  কার্যকর। তা সেই গরম মেঝেতে বসে আছি। মেঝের উপর অবশ্য একটা পাতলা বিছানা পাতা। তাতে একটা উষ্ণ অনুভুতি হচ্ছে। 
       


এখনও সূর্যদয় হয় নি। জানালার স্বচ্ছ কাঁচের ওপারে রাস্তার বাতিগুলো কেমন নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে কুয়াশা নেই। জানালার কাঁচে হালকা একটা বাস্পের আস্তরণ জমেছিল যা কালক্রমে তরল জল ও বর্তমানে বরফের পাতলা  চাদরে পরিনত হয়েছে। সেই বরফের প্রলেপে রাস্তার আলো প্রতিসরণ হয়ে যখন ঘরে প্রবেশ করছে তার উজ্জ্বলতা অনেকাংশে কমে ম্লান হয়ে আসছে। একটু করুণ হয়ে। পাশের গগনচুম্বি অট্টালিকাগুলোর অনেক ঘরের আলোই জ্বলছে। জানিনা কেও ঘুম থেকে উঠে গেছে নাকি সারা রাত ঘুমোয় নি। ওদের জানালা আর আমার জানালার মৃদু অস্বচ্ছতা সেই আলোগুলোকে রাতের কালো আকাশে মিটমিট তারার মত লাগছে। রাস্তায় যান চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে। বিশ্বের বড় বড় শহর রাত জাগতে পছন্দ করে। তাই সারা রাত গাড়ির কোন বিরাম নেই। রাস্তাগুলো বিশ্রাম পায় শুধুমাত্র এই ভোরের বেলায়। একটু বিশ্রাম। 


আজ ঘটনাক্রমে উঠে গেছি একটু সকাল সকাল। ভোরই বলা যায় বাইরে আলো ফোটেনি যখন। পুত্র নিয়ন ও তার মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে মন্ত্রমুগ্ধের মত এসে বসলাম কম্পিউটারের সামনে। এই যন্ত্রটাই এখন সব। কাজ, বিনোদন। অন্তর্জালে এদিক ওদিক দিকভ্রান্ত হয়ে এসে পৌঁছালাম ব্লগে। হঠাৎ চোখে পড়ল ২০১৭ সালে কিছুই লেখা হয় নি। একটা গোটা বছর যে কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। তাই ভবলাম কিছু একটা লিখি। 

ঘরের আলো নেভানো। আধা অন্ধকারে বসে লিখছি। লিখছি বললে ভুল হবে টাইপ করছি কম্পিউটারে। কিবোর্ড়ের হালকা টুকটাক শব্দটা চারিদিকের জমাট নিঃশব্দের বুকে একটু বেমানান লাগছে। এক পেয়ালা গরম চাও বানিয়ে নিয়েছি ইতিমধ্যে। সাথে বিস্কুট। 

জানিনা এরকম সময়ই আবেগ সবসময় আমাকে কেন গ্রাস করে বসে। মন চলে যায় কোন দূর দূরান্তে। স্মৃতিরা ভিড় করে। একএকটা অস্পষ্ট ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঠিকভাবে দেখার আগেই যেন সেটা চলে যায়। অথবা আর একটা ছবি এসে পড়ে তার উপর। মন অশান্ত হয়ে ওঠে। বিচলিত হয় না। সেই অশান্তিও কেমন স্নিগ্ধতায় ভরা। একটা অবশ অবশ ভাব। যেন নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রন নেই।  হর্ষ বিষাদ মিলে মিশে একাকার। চোখ আপনা আপনি বুজে আসে।    

কতদিন সুর্যদয় দেখি নি। মনে পড়ে না শেষ কবে দেখেছি রাঙ্গা লাল সুর্য আকাশকে রাঙিয়ে দিচ্ছে। অন্ধকার কেটে একটু একটু ফর্সা হচ্ছে।  হয়ত কাক ডাকছে পাশের গাছ থেকে। মামার বাড়িতে থাকলে কোঁকোঁর কোঁক মুর্গির ডাকও শুনতে পাই। হালকা ঠান্ডায় চাদর মুড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি আমার বুডো দাদু মাটিতে চাল ছড়িয়ে দিচ্ছে মুর্গিদের খাবার জন্য। পরম যত্নে। এক পাল মুর্গি তা খাবার জন্য দৌড়ে আসছে কোঁক কোঁক করতে করতে। গোয়াল থেকে গরুর হাম্বা হাম্বা আওয়াজ। ওরাও যে জেগেছে। 

একবার সকাল সকাল গিয়েছিলাম জঙ্গলে। শাল দাঁতন বানিয়ে দাঁত মাজার জন্য। সকালের বন আমায় মুগ্ধ করেছিল। শুকনো পাতার উপর চলার মচ মচ শব্দ যেন আমার কানে ভেসে আসছে। 
পাতার কথায় মনে এল, ছোটবেলার ইসপ ফেবেলস বইএ পড়া ঘুঘু আর পিঁপড়ের গল্প। ঘুঘুর ফেলে দেওয়া পাতায় চড়ে কেমন করে পিঁপড়ে ফিরে এসেছিল নদীর পাড়ে। এরকম ভাবে জলের উপর ঘোরার সখ ছিল অনেক দিনের।  

একবার আমাদের গ্রামের পুকুরে একটা ভেলা বানানো হয়েছিল বাঁশ আর খড দিয়ে। মাছ ধরার জন্য। তা জেলেরা সেটা ব্যবহার করার পর পাড়ে বেঁধে রেখে চলে যায়। আমি দেখছিলাম সবকিছু আগাগোড়া আড়াল থেকে। জেলেরা চলে যেতেই আমার কৌতুহলি মন জেগে উঠল। আমি উঠে পড়লাম সেই ভেলায় আর দড়ি দিলাম খুলে। কিছুটা যেতে না যেতেই শুকনো খড় ভিজতে শুরু করল। আর ডুবতে শুরু করল ভেলা। এদিকে আমি সাঁতার জানি না। ভাগ্যিস তখন একজন এসেছিল পুকুরঘাটে। উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিল ঘরে। আর ছোটবেলার সবসময়ের পুরস্কার বিনা পয়সায় বকুনির অভাব ঘটে নি। 

একবার এমনি ভাবেই আমি বসে ছিলাম পুকুরের পাড়ে বহুক্ষণ। বেশ কয়েক ঘন্টা। একটা কাঁকড়ার খোঁজে। এক বন্ধু আমাকে গল্প শুনিয়েছিল সে নাকি কাঁকড়ার পায়ে দড়ি বেঁধে খেলার ধানক্ষেত চাষ করেছিল কাঁকড়ার দাঁড়া দিয়ে। আমারও মনে হয়েছিল আমারও একটা কাঁকড়া চাই। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কাঁকড়া কোথায় পেলি? সে বলেছিল পুকুরের পাড়ে বসেছিলাম। একটা কাঁকড়া জল থেকে উঠে এল। আমি গিয়ে ধরে ফেললাম। আমিও অপেক্ষা করেছিলাম পুকুরপাড়ে জলের ধারে। ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ে ছিলাম জলের দিকে। অধির আগ্রহে। কোন কাঁকড়া উঠে আসে নি। 

বসে থাকার আর একটা কাহিনী মনে আসছে। তখন ছোট ছিলাম। অনেক ছোট। সবে হয়ত গুনতে শিখেছি। ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা দেখিয়ে বাড়িতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এটা কি? কাকু বলেছিল এটা দিয়ে সময় মাপা যায়। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কি ভাবে? কাকু বলেছিল এই যে বড় কাঁটাটা আছে সেটা এক পাক ঘুরলে এক ঘন্টা হয়। কাকু আমাকে ছোট ভেবে সেদিনের ক্লাস ওখানেই শেষ করেছিল। আমি ভেবেছিলাম আমি জেনে গেছি সময় কি আর ঘড়ি কি ভাবে দেখে। সেদিন দুপুরে বাড়ির সবাই অলস আড্ডায় ব্যস্ত ছিল। কেও একটা আনমনে জিজ্ঞাসা করেছিল কটা বাজে? হঠাৎ আমি বলে উঠেছিলাম আমি দেখে আসছি কটা বাজে। আমার জ্ঞান এটুকুই যে বড় কাঁটাটা একবার ঘুরলে এক ঘন্টা হয়। সেদিন আমি ঘড়ির সামনে একঘন্টা বসেছিলাম। উত্তপ্ত দুপুরে কেও খেয়াল করে নি আমি কত ঘামছি। এক ঘন্টা পর যখন আমি ফিরে এসেছিলাম কেও আমাকে জিজ্ঞাসা করে নি কটা বাজে। আমি মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি ঘড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। ঘরের সবাই তো অবাক। এতক্ষন কি করছিলাম। যাই হোক শেষে জিজ্ঞাসা করেছিল কটা বাজে। আমার উত্তর ছিল এক ঘন্টা হয়ে গেছে। সেদিন না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম কেন তখন ঘরে হাসির রোল উঠেছিল।
 
দুপুর মানেই তা শেষ হয়ে আসবে বিকেল। আর বিকেল মানেই খেলা। খেলার মাঠে যে কি কি ঘটেছিল সেই ছবি একটার পর একটা এসেই চলেছে। অজস্র। অফুরন্ত। ছেলেবেলাটাই যে কেটেছে খেলার মাঠে। কখনও ভাবি নি বিকেল বেলাও ঘরের ভেতর কাটানো যায়। সেই বর্ষার বিকেলে কাদামাঠে ফুটবল খেলা আর একবার খেলতে চাই। সেই সারা বিকেল এদিক সেদিক সাইকেল নিয়ে ঘোরা আর একবার ঘুরতে চাই। ঘড়িকে পিছনে ঘুরিয়ে যেতে চাই সেই বিকেলে যেদিন বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর ঘর থেকে। লুকোবার জন্য। কিন্তু লুকোবার জায়গা পাই নি। বন্ধুরা খুঁজে না পেয়ে আমাকে ছাড়াই শুরু করেছিল খেলা। সন্ধ্যা হতে সবাই ফিরে গিয়েছিল ঘরে। আমি ছাড়া। অজানা জায়গায় সন্ধ্যা হওয়ায় রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। অন্য গ্রামের কোন অজানা লোক সাইকেলে করে আমায় ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল ঘরে। ঘরের বকুনি তো উপরি পাওনা। 

সেদিন ভাবি নি আজ কুড়ি তিরিশ বছর পর কোন এক ঠান্ডা সকালে দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে সেই দিনের ঘটনা চোখে জল আনবে। হারিয়ে যেতে চাই আবার সেদিনের মত। জানি আজ আর কেও সাইকেলে করে আমায় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে না ঘরে। সাইকেলের হয়ত অভাব নেই এখনও কিন্তু ঘরের বড় অভাব। ছোট থেকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা ঘুরতে ঘুরতে যেমন দুনিয়াকে ঘর করে নিয়েছি তেমনি হারিয়েছি নিজের ঠিকানা। ঘর বলতে আর কোন জায়গার ছবি হঠাৎ মাথায় আসে না। একটা ঘর চাই। 

বাইরে ধীরে ধীরে আলো ফুটছে। লাল হচ্ছে আকাশ। পাশের পাহাড়ের মাথার উপর তার আভা এসে পড়েছে। কি সুন্দর।  স্বপ্ন দেখছি কি? কেন বার বার মনে হচ্ছে কবে কোথাও ঘটেছে এই ঘটনা। মনটা কেন শিশু হয়ে উঠছে আজ? 

রাস্তায় একটা গাড়ির হর্নের বিকট আওয়াজ নিঃশব্দ খান খান করে দিল।  

সব সুন্দরই কোন অসুন্দরকে ঢাকার চাদর। সুন্দরের ঠিক নিচে থাকে একটা কঠোর বাস্তব। যেমন ওই ঢেও  খেলান অপরূপ পাহাড়ের নিচেই আছে কঠিন পাথর, ওই লাল সুর্যের ভেতর আছে গনগনে আগুন।  

ফিরে এলাম বাস্তবে। সিওল। ১২ই ডিসেম্বর। বাইরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ১৫ ডিগ্রী নিচে। 

পুত্র নিয়ন হাত পা নাড়তে শুরু করেছে। খেলতে হবে ওর সাথে। দেখি ছেলেবেলা আবার শুরু করতে পারি কি না।