Wednesday, November 26, 2014

ছদ্ম নিরপেক্ষ

প্রিয় আনন্দবাজার পত্রিকা,
                                       প্রথমেই বলে রাখি আমি তোমার প্রতিদিনের একনিষ্ঠ পাঠক। সেই ছোটবেলা থেকে। হয়ত ঘরে আসত বলে ছোটবেলায় আমার কাছে বাছার আর কোন সুযোগ ছিল না। তবে যত বড় হতে লাগলাম তত আমি আনন্দবাজার এর ভক্ত হতে লাগলাম। সকালবেলায় আনন্দবাজার না পেলে যেন মন ভরত না। বাংলা ভাষায় যতগুলি দৈনিক পত্রিকা আছে তার মধ্যে ভাষা, পরিবেশনা, আর উপস্থাপন এ তর্কাতিত ভাবে সেরা খবরের কাগজ। লক্ষ লক্ষ আরও পশ্চিমবঙ্গ বাসীর (বা প্রবাসীর) মত আমিও বিশ্বাস করেছিলাম যে "আনন্দবাজার - পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।"
  অনেক বয়স পর্যন্ত খেলা আর বাকি সামাজিক খবর, দুর্ঘটনার খবরই আমার চোখ কে আকর্ষণ করত বেশি। কারন না আমি খুব একটা ইতিহাস জ্ঞান সম্পন্ন ছিলাম না রাজনৈতিক ভাবে সচেতন। বিশেষ করে রবিবাসরীয় বা অন্যান্য অতিরিক্ত পাতা তো খুবই টানত আমাকে।
  ধিরে ধিরে যত বড় হতে লাগলাম, আস্তে আস্তে একটু আধটু ইতিহাস বা রাজনিতির জ্ঞান বাড়তে লাগল। আর বুঝতে শিখলাম সব পত্র পত্রিকার খবর পরিবেশনার সাথে সাথে আর একটি দায়বদ্ধতা আছে। তা হল নিরপেক্ষতা - বিশেষ করে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা। বিশেষ করে সংবাদপত্রের কাজ খবর পরিবেশন করা,  মতামত দেওয়া নয়। আর তখনই প্রথম আঘাতটা লাগল।

 
 যাকে আমি সেরা সংবাদপত্র বলে ভাবতাম তার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব দেখে খারাপ লাগল। কিন্তু অনেক মানুষের মত আমারও এই পক্ষপাতিত্ব অনেক দিন চোখে পড়ে নি বা আমি অনুভব করি নি।  কারন আনন্দবাজার পক্ষপাতিত্ব ও করে খুবই সুচারু রুপে, সাধারন মানুষের দৃষ্টিতে যা অনেক সময়েই ধরা পড়ে না।  বাকি সংবাদপত্রগুলি সব সময় একই দলের পক্ষপাতিত্ব করে। তাই সবাই বুঝতে পারে যে কে কোন দলের হয়ে বলছে। আমার মনে হয় সেটাও এক দিক থেকে ভাল। কারন পাঠক প্রস্তুতই থাকে যে কি রকম খবর সে আশা করে। আর তাই যখন সে খবর পড়ে তখন মনে মনেই ফিল্টার করে ফেলে খবরকে। একটা আন্দাজ করে নেয় যে আসল খবরটা কি হতে পারে। গনিতের ভাষায় বলতে গেলে “বিচ্চুতি” বা “Debiation” সব সময় এক থাকে।
  কিন্তু আনন্দবাজার সুচারু ভাবে সব সময় রঙ বদলায় ঠিক গিরগিটির মত। যখন হাওয়া যে দিকে তার হয়ে লেখায় আনন্দবাজার সিদ্ধহস্ত। তাই আনন্দবাজারের নিরপেক্ষ হীনতাটা সাদা চোখে ধরা যায় না। এই ছদ্ম নিরপেক্ষতা সোজা পক্ষপাতিত্বের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ভেতরের ব্যাপার আমার জানা নেই যে এর থেকে আনন্দবাজার এর বিক্রি বাড়ে না তারা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে টাকা / বাড়তি সুযোগ সুবিধা পায়? বা শুধুমাত্র জনপ্রিয়তার জন্য এরকম করে? কিন্তু এতে জনগনের ও দেশের অনেক ক্ষতি হয়।
আমার মনে আছে যে যখন শেষ বার এর জন্য বামফ্রন্ট সরকার জিতেছিল পশ্চিমবঙ্গে তখন আনন্দবাজার খোলাখুলি সি পি এম এর বিরুদ্ধে লিখত। তখন সি পি এম যাই করুক না কেন তার কোন ভালই আনন্দবাজার দেখতে পেত না। আবার সেই আনন্দবাজারই সিঙ্গুরে কারখানা গড়ার বিরুদ্ধে যখন মমতা অনশন শুরু করে তখন হঠাৎ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একদম গুনমুগ্ধ ভক্ত হয়ে উঠল। তখন পাতার পর পাতা বুদ্ধস্তুতি। জানি না কেন হঠাৎ আবার রঙ পরিবর্তন করে কিছুদিনের মধ্যেই আনন্দবাজার মমতার জয়গান শুরু করে। মমতার জয়ের পিছনে অনেক কারনের মধ্যে আনন্দবাজার ও পড়ে। জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আপাতত আনন্দবাজার বি জে পি তে মজেছে। প্রতিদিন খবর এ শুধুই বিজেপির জয়গান। এখন মমতা যাই করুক না কেন (আমি দাবি করছি না মমতা সবকিছু ভাল করছে) দু চারটে মমতা বিরোধী প্রবন্ধ তো থাকবেই। জানি না পরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে আবার কার দিকে ঝুঁকবে আনন্দবাজার।
  একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে লক্ষ করার আছে। সরকার খারাপ কিছু করলে খবর বিভাগে তা দেখান কখনই নিরপেক্ষহিনতা নয়। কিন্তু সম্পাদকীয় বিভাগটি সম্পূর্ণরূপে ব্যাক্তিগত মতামত। তাই সেখানে কিছু লেখা হলে ধরেই নেওয়া যায় যে সেটি খবরের কাগজের বর্তমান অবস্থান।
প্রিয় আনন্দবাজার, খুবই মর্মাহত মনে একজন সাধারন পাঠক হিসাবে তোমার কাছে আমার মিনতি নিজের নিরপেক্ষতা এই নির্লজ্জ ভাবে খুইয়ো না। অনেক আশা রাখি তোমার কাছে। এতো অভিযোগ এর পরও কাল থেকে আমি তোমার ই পাঠক থাকব। তাই এমন কাজ কোরো না যাতে তোমার উপর ভরসা উড়ে যায়। সেটা কিন্তু তোমার নিজের খ্যাতির প্রতিই অবমাননা হবে। নিজের কলাম এ সকলকে তার কার্যভার মনে করিয়ে দেওয়া অনেক সোজা, সেই কাজটি এবার নিজে করে দেখালে যার পর নাই খুশি হব। এই বিদেশ বিভূঁই এ বসেও ইন্টারনেটে সকাল সকাল anandabazar.com এ ক্লিক করতে যেন হাত না কাপে সেই ভরসা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করবে এই আশাতেই প্রতিক্ষা আর পর্যবেক্ষণরত রইলাম।
                                                                                                                                                                            ইতি,
তোমার গুনমুগ্ধ ও হৃদয় ভারাক্রান্ত পাঠক

সন্দীপন।


কোরিয়া
২৬/১১/২০১৪