Tuesday, July 29, 2014

গেঁয়োর বিদেশ যাত্রা !!!

ছোটবেলায় একটা কবিতা পড়েছিলাম

"খুড়োর ছিল উড়োজাহাজ, কল ছিল তার ভাঙ্গা
সেই জাহাজে চলল খুড়ো শূন্যে পারুলডাঙ্গা।
মাঝ আকাশে গোঁত্তা খেলে
 পড়ল খুড়ো নদীর জলে
লজ্জা এবং অপমানে মুখটি হল রাঙ্গা
নদীর জলে সাঁতরে খুড়োর মনটি হল চাঙ্গা।"

কবিতাটা আমার বেশ প্রিয় ছিল। আজও আছে অবশ্য। বেশ একটা হালকা হাসির কবিতা। তবে আমার বেশ সন্দেহ হয় যে এই কবিতাটা লিখেছিল সে জীবনে কখনও উড়োজাহাজে চড়েছে কিনা। ভাবো কোথাও কিছু নেই খুড়ো উড়োজাহাজ নিয়ে চললেন পারুলডাঙ্গা। এ যেন সাইকেল নিয়ে বাজার যাওয়া। এই উড়োজাহাজ এর কবিতাটা আরও হাসি লাগে যখন থেকে উড়োজাহাজে চড়েছি। 
 
   সে এক ঘটনা। 
 
বেশ ছিলাম। হঠাৎ একদিন খবর এল বিদেশ যেতে হবে। শুনেই তো মনটা নেচে উঠল। বিদেশ যাওয়া মানেই উড়োজাহাজে চড়া। যতই কর বাবা, আর সড়কপথে নয়। এবার উড়োজাহাজেই যেতে হবে। বিদেশ যাওয়ার যা না আনন্দ ছিল তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ ছিল প্লেন এ চড়ার সুযোগ পাওয়ায়। কি আনন্দ, কি আনন্দ। আসল ওড়ার আগেই হাওয়ায় উড়ছি যেন। 
  যাই হোক। বিদেশ যেতে গেলে অনেক কাজ থাকে, ব্যাগ গোছানো ছাড়াও। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ভিসা করানো। আশেপাশে কোথাও ভিসা করানো যায় না। অগত্যা দিল্লি চল। বেশ ফুর্তি ফুর্তিতে ট্রেনে চড়ে বসলাম। ব্যাস দেখতে দেখতে দিল্লি পৌঁছে গেলাম। এক কলেজতুতো দাদার কাছে থাকার ব্যাবস্থা করে ফেলেছিলাম। তাই থাকা খাওয়ার কোন চিন্তা ছিল না। 
 
  ট্রেন এ একটা মজার ঘটনা হল। এক বাঙ্গালী লোকের সাথে পরিচয় হল। কথায় কথায় জানা গেল সে কোন এক সাধুর ভক্ত যে কিনা আমাদের পারিবারিক গুরুর পরিচিত। আহা কি কাছের সম্পর্ক ! এসব ক্ষেত্রে সেন্টিমেন্ট আমার জানা। লোকজন হঠাৎই কেমন নিজেকে অনেক কাছের মনে করে। আমিও ঝুলে পড়লাম তার সাথে। মানে এক বেলার জন্য। সে বলল সে নাকি এখন সেই সাধুর আশ্রমেই যাচ্ছে। সেখানে নাকি থাকা খাওয়া ফ্রি। ফ্রির জিনিস কে না ছাড়ে। গেলাম তার সাথে। আমাকে তার গুরুর সাথে এমন ভাবে পরিচয় করিয়ে দিল যেন আমি তার কতদিনের পরিচিত। তবে হ্যাঁ গুরু যে খুব কেয়ার করলেন তা মনে হল না। আশ্রমে এমনিতেই লঙ্গর চলছিল। একজন তাতে যোগ দিলে কারো কিছু এসে যাবে বলে মনে হল না। সাধুদের খাবার বলে কথা। বিশুদ্ধ ঘিএর তৈরি। ট্রেনযাত্রার ধকল আর খিদে ছিল  যথেষ্ট পরিমানে। যখন উঠলাম তখন পেট এতটাই ভরে গেছে যে উঠতে পারছি না। বললাম এই আশ্রমে একটু বিশ্রাম নেওয়া যায় না? লোকটা বলল কেন নয়? চল একটা ঘর দিচ্ছি শুয়ে পড়। আহা হাতে যেন চাঁদ পেলাম। একদম নাক ডাকিয়ে ঘুম দিলাম।
 
ঘুম থেকে যখন উঠলাম তখন প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে পৌছালাম দাদার কাছে। কাজ বলতে ভিসা করান আর ফ্লাইট টিকিট কাটা। মোট পাঁচ দিন লাগবে।
  পরদিন সকালে গেলাম কোরিয়ান এমবাসিতে। দিল্লির এই চাণক্যপুরি এলাকাটা খুবই সুন্দর। একদম শান্ত ছিমছাম। গাছ গাছালিতে ভর্তি। মনেই হয় না দিল্লির মত বড় শহরে আছি। লোকজন কম। আর বিভিন্ন দেশের বিদেশ দফতর। প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব স্থাপত্যের ঐতিহ্য অনুসারে ঘরগুলো বানিয়েছে। একটু ঘরাঘুরি করলে মনে হয় পুরো দুনিয়াটা হৃদয়ে অনুভব করলাম।
  কোরিয়ান এমবাসিতে দাঁড়িয়ে আছি। একজন এজেন্ট ফোনে কথা বলছে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। হিন্দিতে একটা হরিয়ানার টান। বড় মধুর লাগে। আর একজন এজেন্টের সাথে কথা বলছে।
"হ্যালো, কাঁহা হ্যাঁ তু?"
"............"
"ম্যা কোরিয়া মে হু, থড়ী দের রুখ, আমেরিকা হোকে আধা ঘন্টে মে ফ্রান্স পউছ রাহা হু"

আহা। দুনিয়াটাকে হাতের মুঠোয় এরাই রাখে ! কথায় কথায় জানা গেল সে বিমান টিকিটও বিক্রি করে। সে তার কার্ড দিল। বলল ভিসা হলে বোলো, তোমার টিকিট করিয়ে দেব।

 সারা দিন দিল্লিতে গলি গলি ঘুরলাম। সাথে একটা ম্যাপ ছিল। কোন অসুবিধা নেই। রাতে ফিরে এলাম দাদার ঘরে। ওরা তিনজন থাকে একসাথে একটা ঘর ভাড়া করে। একজন ছিল যে বিমানবন্দরে কাজ করে। আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। কখন বিমানবন্দর দেখি নি। ঠিক হল কাল যাব ওর সাথে এয়ারপোর্ট দেখতে। বেশ উত্তেজনায় কাটল রাতটা।
 
   পরদিন গেলাম এয়ারপোর্টে। আমার স্বপ্ন। ছোটবেলা থেকে কত শুনেছি প্নেন আর এয়ারপোর্টের ব্যাপারে। সত্যি এ এক রাজসুয় জজ্ঞ। কি বিশাল। সবাই কি কেতাদুরস্ত। নিজেকে একবার দেখলাম। সবার তুলনায় একটু গ্রামিন গ্রামিন লাগছে। নিজের কনফিডেন্স লেভেলটা একটু বাড়িয়ে নিলাম। (এমন অবস্থায় এ ছাড়া আর কিছু করার নেই)। সুন্দরী সুন্দরী বিমানসেবিকারা যাচ্ছে। যাচ্ছে তো নয় যেন প্রজাপতির মত উড়ছে। যাই হোক মনে মনে একটু শক্তি আনলাম। আর যাই হোক না কেন আমিও কদিন বাদে এদের মতই প্লেনে চাপব।
 
  দাদা একটু আধটু বুঝিয়ে দিল। কোথা থেকে টিকিট পাওয়া যায়, কোথা কি কি আছে। আমি তো অবাক চোখে দেখছি। কি চকচকে চারিদিক। মনে হল সত্তি "ভারত আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে"। এর আগে কয়েকবার প্লেন ওঠানামা দেখেছি, তবে দূর থেকে। একবার হায়দ্রাবাদে এয়ারপোর্টের পাঁচিলের উপর উঠে,  আর একবার চেন্নাইএ। দূর থেকে তো দারুন লেগেছিল। কিন্তু এবার এয়ারপোর্ট দেখে সত্তি মোহিত হয়ে গেলাম।
 
  কিছুক্ষণ পর আমার ঘোর কাটল। দাদার ভেতরে ডিউটি ছিল। ও ভেতরে চলে গেল। আমি ভাবছি কি করা যায়। আসলে শুধু বসে থাকতেই দারুন লাগছিল। বেশ নূতন নূতন জিনিস। ট্রলিতে মাল বোঝাই করে সব বের হয়ে আসছে। আর যারা রিসিভ করতে এসেছে তারা কি আনন্দে ফেটে পড়ছে প্রিয়জনকে দেখে। ঠিক যেমন সিনেমাতে দেখায়। একদিকে মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র। ডলার, পাউন্ড, ইয়েন সব চিহ্ন।
ভাবলাম কাজের কাজ একটা কিছু করে ফেলি। আমাকে টিকিট তো কাটতেই হবে। এখনই কেটে নিলে কেমন হয়? সারি সারি সব এয়ারলাইন্সের কাউন্টার। সেখানে সুন্দরী সুন্দরী তরুণীরা টিকিট বিক্রি করছে। এই তো সুযোগ। অন্তত ওদের সাথে কোথা বলার তো একটা সুযোগ পাওয়া যাবে।
 
  একটু ভয় ভয় করছিল। ওদের সাথে স্মার্টলি কথা বলতে হবে। শুনেছিলাম স্পাইসজেট সস্তায় টিকিট দ্যায়। গেলাম ওদের কাউন্টারে। "ক্যান আই হ্যাভ এ টিকিট প্লিজ?" এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম।
প্রশ্ন এল "কোথায় যাবেন?"
"সিওল"
"কোথায়?!!!"
"সিওল"
"স্যার, আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড, হোয়ের ডু ইউ ওআনা গো?"
"সিওল, ক্যাপিটাল অফ কোরিয়া"
মাতাজী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। জীবনে প্রথমবার এরকম প্রশ্ন শুনলেন যেন। হয়ত ভাবছিল কোন গ্রাম থেকে উঠে এসেছে রে বাবা? অথবা,  গুলিয়ে ফেলছিল যে, যে সিওলের সিওলের টিকিট চাইছে সে আর যাই হোক গ্রামের হতে পারে না।
"স্যার অ্যাকচুয়েলি দিস ইস ফর ডোমেস্টিক ফ্লাইট"
হাঃ হাঃ...। বেশ মজা পেলাম। বুঝে গেলাম এখানে কোন কাউন্টারেই সিওল এর টিকিট পাওয়া যাবে না। তাই জেনে বুঝে সবাইকে বিরক্ত করতে লাগলাম। আর সবার অভিব্যাক্তি দেখতে লাগলাম। বেচারা আমাকে গালিও দিতে পারছে না আর সইতেও পারছে না।
   ধীরে ধীরে আমি প্রশ্ন বাড়াতে লাগলাম। আপনার কাছে পাওয়া যাবে না তো কোথায় পাওয়া যাবে? ইত্যাদি। টাইম পাস দারুন হচ্ছিল। বিনা পয়সায়।
  সব কাউন্টার যখন শেষ হল তখন বাইরে এলাম। বাইরে তখন ঝিম ঝিম বৃষ্টি হচ্ছিল। দিল্লিতে দুটো বিমানবন্দর ছিল। একটা ডোমেস্টিক আর একটা ইন্টারন্যাসানাল। এখন মনে হয় একটাই হয়ে গেছে। আমি ছিলাম ডোমেস্টিক টারমিনালে। ভাবলাম ইন্টারন্যাসানালটাও দেখে আসি।
 মুস্কিল হল এই দুটো এয়ারপোর্ট এর মধ্যে কোন বাস বা ট্রেন নেই। ট্যাক্সিই ভরসা। হাতে বেশি টাকা নেই। তাই টাক্সির চিন্তা ছেড়ে দিলাম। তখন ঝিম ঝিম বৃষ্টি পড়ছে। কি করি কি করি? দেখি একটা বাস যাচ্ছে ইন্টারন্যাসানাল টারমিনালে। কিন্তু সমস্যা হল সেটা সাধারন যাত্রীদের জন্য নয়। যারা ডোমেস্টিক ফ্লাইট থেকে নেমে ইন্টারন্যাসানাল এ যাবে তাদের জন্য। এখন দুটো রাস্তা আছে আমার কাছে। এক,  এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কোথাও গিয়ে বাস ধরে ঘর অথবা এই বাসে কোন রকমে ম্যানেজ করে চড়ে যাও। ভাবলাম দেখাই যাক না চেষ্টা করে। বেশি হলে কি হবে? নামিয়ে দেবে। আমাকে কে আর চেনে এই দিল্লীতে। যেমন ভাবা সে রকম কাজ। চড়ে বসলাম। বেশিরভাগ যাত্রীই বিদেশী। সবার সামনে নামিয়ে দিলে কি অপমানটাই না হবে। একটা ফন্দি আঁটলাম। কন্ডাক্টার এলে বলব জানতাম না। তাই চড়ে বসেছি। আর একবার নিজেকে দেখলাম। অতটা খারাপ দেখতে নই। মানে বললে বিশ্বাস করবে মনে হয়। প্রতিটা মিনিট অনেক লম্বা লাগছে। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম। আসলে বাসটা ফ্রি সারভিস। আহা কি মজা।
 ইন্টারন্যাসানাল টারমিনাল দেখে তো আমার চক্ষু ছানা বড়া। বাপরে কি বিশাল। এই এয়ারপোর্টটা আরও ফাঁকা ফাঁকা। বাস একদম দুতলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বাপরে। এতো বড় এতো বড় যে পায়ে হেঁটে শেষই করা যায় না। আমি তো চারিদিকে ঘুরতে লাগলাম।  
 আগে চলন্ত সিঁড়ি দেখেছিলাম। কিন্তু এখানে দেখলাম চলন্ত বেল্ট। কি মজা। করিডর এ হাটতে হবে না, চলমান ফিতায় চড়ে যাও এগিয়ে যাবে। তাও আবার ফ্রি। এই ফ্রির জিনিস আমাদের খুব টানে। আমি তো বার বার চড়লাম। এখানে আবার অনেক বিদেশী লোক।
  আবার সেই টিকিট এর কথা মাথায় এল। ভাবলাম এটা তো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হয়ত এখানে সিওল এর টিকিট পাব। আর যদি নাই পাই, মজা তো হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। অনেক কাউন্টার ঘুরলাম। অবশেষে এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টার এ গেলাম।
  ওরা একটা মজার কথা বলল। বিমানেও নাকি ছাত্রদের জন্য ছাড় আছে। আমি বাসে ট্রেনে স্টুডেন্ট ডিস্কাউন্ট এর কথা শুনেছিলাম, কিন্তু তা বলে একেবারে বিমান টিকিট এ ছাড়? বলল সফদরজং বিমানবন্দর এ নাকি এয়ার ইন্ডিয়া র অফিস আছে। সেখান থেকে পাওয়া যাবে।
  ব্যস আর কি ? মিশন সফদরজং। হাতে একটা ম্যাপ ছিল। খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম। সফদরজং এ গিয়ে একজন কে জিজ্ঞাসা করলাম "দাদা এখানে বিমানবন্দরটা কোথায় বলতে পারবেন?" সে আমার মুখের দিকে কেমন যেন উদাস ভাবে তাকাল। বলল এখানে কোন বিমানবন্দর নেই।
আমিও ছাড়ার পাত্র নই। একদম সোজা ম্যাপ খুলে দেখিয়ে দিলাম। সে তো হতবাক। হাতের কাছে একটা আস্ত বিমানবন্দর আছে আর সে দিল্লির লোক হয়ে জানে না?
 আসলে হয়েছে কি, সফদরজং এ সত্যি একটা বিমানবন্দর ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা ব্যবহার হয় না। সে তো আর আমি জানি না, আর সেও জানে না।
  যাই হোক। অবশেষে পৌঁছান গেল এয়ার ইন্ডিয়া র অফিসে। কিন্তু দুঃখের কথা কোরিয়া র জন্য কোন ছাড় নেই। বড় দুঃখ পেলাম।
  ফিরে এলাম ঘরে। দিন চার এর মধ্যে ভিসা পেয়ে গেলাম। এবার যাত্রা শুরু।

দিনটা মোটামুটি মনে আছে। ২৭এ সেপ্টেম্বর ২০১০। সকালে সূর্যটা আর পাঁচটা দিনের মতই উঠেছিল। কিন্তু আমার কাছে এক ব্যাতিক্রমি, এক অন্য সকাল। খুবই উত্তেজিত ছিলাম। কলকাতা বিমানবন্দরে যখন পৌছালাম তখন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আনন্দ করব না দুঃখ করব। একদিকে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমন এর অভিজ্ঞতা আর অজানা ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আর এক দিকে বাবা মা কে ছেড়ে যেতে হবে। এক অদ্ভুত মিশ্র ঘোরের মধ্যে সময় কাটছিল। অবশেষে বাবা মাকে প্রনাম করে ঢুকলাম এয়ারপোর্ট এর ভেতর। আমার বোন সবসময় একটা অশ্রু সজল বিদায় জানায় আমাকে।

 একটা শিহরন হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম না এটা বাস্তব না স্বপ্ন । ধীরে ধীরে গিয়ে ঢুকলাম প্লেন এর মধ্যে। অনেক দিনের অনেক প্রশ্নের সমাধান পেলাম। আগে ভাবতাম এত ছোট প্লেন (দূর থেকে প্লেন ছোটই লাগে) এর মধ্যে লোক ঢোকে কি করে? এখন বুঝলাম এটা ঠিক এতোটা ছোট নয়।
  ফ্লাইট যখন রানওয়ে ছাড়াল তখন আমার শরীর আর মন দুটোই আকাশে। সাথে আবার খাবার দাবার এর  আয়োজন। আহা বড় আরাম। কি খাতির। "হোয়াট উড ইউ লাইক  'স্যর' ?" শুনে তো নিজেকে বেস কেওকেটা লাগছিল। টাকা থাকলে যে এক দিনেই 'স্যার" হওয়া যায় সেটা দেখলাম। আর বেশ মজা নিলাম।
  প্লেনটা ধীরে ধীরে উপরে উঠছে, বাপরে !! মেঘগুলো তো আমার পাশে পাশে। ক্রমশ মেঘের দেশ ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠে পড়লাম। স্বর্গ কি এখানেই কোথাও?

 দু ঘন্টায় দিল্লি। আহা রে। কি মজা কি মজা। বের হয়ে দেখি আরে এই তো সেই ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট। এখান থেকে ইন্টারন্যাসানাল এয়ারপোর্ট এ যেতে হবে। মানে আবার সেই ফ্রি বাস। একদিন এই বাসেই কি ভয়ে ভয়ে চড়েছিলাম। আজ একদম গর্বভরে গেলাম। মাথা উঁচু করে। টাকার কি ক্ষমতা।

সাথে কিছু মালপত্র ছিল। বাস এর হেল্পার কে বললাম "ভাইয়া সামান উঠাও"। এমন নয় যে আমি তুলতে পারতাম না। কিন্তু আজ অনেক দামি প্লেন এর টিকিট আছে আমার কাছে !!! টাকার গরম। নাকি পাগলের গোবধেই আনন্দ !!!

 যাই হোক, আবার বিমান যাত্রা। এবার সাড়ে ন ঘন্টা।

ছোট ফ্লাইট থেকে বড় ফ্লাইট। বাপরে কি বড়। যেন একটা আস্ত ঘর। একসময় সেও উড়ল।

 আমার মন তখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

  

  

Saturday, February 22, 2014

অলস সকাল - আজ রবিবার

নিউটনের প্রথম সুত্র বলে "বাইরে থেকে প্রযুক্ত কোন বল দ্বারা বাধ্য না করা হলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির আর চলমান বস্তু চিরকাল সমবেগে সরলরেখায় গতিশীল থাকবে।"

   বাপরে সুত্রটা এখনো মনে আছে দেখছি! আরে নিউটন এর সুত্র বলছি বলে আবার ভাববেন না যেন আমি বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি। আসলে আমি যে কি নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি নিজেই জানি না। সত্যি কথা বলতে কি আমার কিছুই বলার নেই।

  একটা রবিবার সকাল (না দুপুর? এখন চারটে বাজে)।
অত্যন্ত অলস দিন বলতে যা বঝায় তাই। ঘুম থেকে দুপুর দুটোর সময় উঠে মনে হচ্ছে যেন দুনিয়াকে ধন্য করে দিয়েছি। সেই যে উঠেছি তার পর থেকে বসেই আছি। না শুধু বসে নেই। সাথে ল্যাপটপ, আমার বন্ধু, আমার শত্রু, আমার দুনিয়া। বসে আছি তো বসেই আছি।

   এখন একটা অদ্ভুত ক্ষমতা হয়েছে। কিছু না করেই আমি সময় কাটাতে পারি। এক যায়গায় বসে বসে। শুনেছি প্রাচীন কালে মুনি ঋষিদের এই ক্ষমতা ছিল। তারা যখন ধ্যানে বসতেন তখন নাকি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতেন এক যায়গায়। শুধু কি ঘন্টা? শুনেছি এক মুনি নাকি এমন ধ্যানে বসেছিলেন যে তার চারিদিকে উইএর ঢিবি হয়ে গিয়েছিল। এখনকার দিন হলে অবশ্য এটা হতে পারত না। সরকারের লোক এসে ঠিক উই মারার তেল ছড়িয়ে দিয়ে যেত।
 
 আর এক মুনি তো এক বট গাছের তলে বসে বসেই এমন ধ্যান করলেন যে প্রায় মরতে বসেছিলেন।কোন এক নারি একবাটি পায়েস দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন। মুনি ঋষিরা বসে বসে অনেক কিছু বিচার করতেন। তা থেকে অনেক ভাল ভাল কিছু উৎপন্ন হত। যেমন হয়েছিল রামায়ন, যেমন বৌদ্ধ ধর্ম। যারা এসব করতেন তাদের বিশেষ নামে ডাকা হত। মহাপুরুষ।মহামানব। তারা ছিলেন বিশেষ বার্তাবাহক।ইংরেজিতে "Messenger" কালের বার্তা। যুগের বার্তা। মানবজাতির বার্তা।

 কথায় বলে, "ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় ( History repeat itself)" । তা সত্যি। বার্তাবাহকরা আবার ফিরে ফিরে আসছেন। শুধু আসছেন ই না, অনেক অনেক আসছেন।  তবে ছোট্ট একটা পার্থক্য। এনারা মানব বা মহামানব নন। আসলে প্রাণীও নন। যন্ত্র। এনারা হলেন, "Whatsapp", "Yahoo Messenger", "MSN", "Skype", "Google Messenger", "Viber" ...... শুধু গুনতে যাও... শেষ হবে না। মানবজাতির শুরু থেকে গত পাঁচ হাজার বছরে যত বার্তাবাহক এসেছেন শেষ পাঁচ বছরে তার চেয়ে অনেক বেশি Messenger এসে গেছে।

  এখন বার্তা বাহকের (Messenger) কম নেই কম শুধু বার্তার। এমন এক বার্তা যা মানবজাতিকে ফের ঠিক রাস্তা দেখাতে পারে।

চল ছাড়। এমন গম্ভীর কিছু বলার জন্য আমি বসি নি। কিন্তু কি বলার জন্য বসেছি? কিছুই না।

আসলে এই রবিবারটা খুব মজাদার। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার কোন তাড়া নেই। না তাড়া আছে ঘুম থেকে উঠে কিছু করার। বেশ স্বাধীন স্বাধীন লাগে। বিশেষ করে যখন একা একা তখন তো কোন কথাই নেই। মনে হয় যেন রাজা। ঘরটা আমার সাম্রাজ্য। এই বিছানাটা, ওই কাপড় জামা রাখার ফ্রেমটা (হ্যাঁ, ফ্রেমই, আমার কোন আলমারি বা আলনা নেই) , রান্নার গ্যাস স্টোভ, মাইক্রো ওভেন, জুতো রাখার র‍্যাকটা, ফ্রিজ, আর এই ল্যাপটপটা। সবাই আমার খুব বাধ্য। আমার অনুমতি বিনা কেও নড়াচড়া করে না।

  আর ল্যাপটপটা তো আমার অল ইন ওয়ান মন্ত্রি। আমার গান শোনায়, খবর শোনায়, সিনেমা দেখায়, হিসাব কষে... কি কি যে করে তার কোন শেষ নেই। শুধু অর্ডার দাও। কোন প্রতিবাদ নেই, কোন চিকমিক নেই। সোজা নির্দেশ পালন। আহা। কি বাধ্য। এমন সাম্রাজ্য কোন রাজা পেয়েছে বলে আমি জানি না। এমন শান্তি, এমন সুখি প্রজা। কোন অভিযোগ নেই। কোন বিদ্রোহের ভয় নেই, নেই কোন সাম্রাজ্য পতনের আশঙ্কা। অপার শান্তি।

  এই তো চাই আমরা জীবনে।

দেখ, কিছু বলার নেই তাতেই এতো কথা বলে ফেললাম। বাপরে। হ্যাঁ, ইতিমধ্যে আর একটা মহান কাজ করে ফেলেছি। চা বানিয়ে ফেলেছি। আহা, গরম চায়ে চুমুক, সাথে গান, খবরের কাগজ পড়, ফেসবুক, চ্যাটিং, আড্ডা। জীবন কি সুন্দর।
  অনেক লিখে ফেলেছি। আজ আর না। কুঁড়েমি শিরায় শিরায় ঘিরে ধরছে। মন বলছে একটু রেস্ট নে। তবে হ্যাঁ একটা কাজ আছে ।একটু রান্না করতে হবে। গান তো চালুই আছে। গান শুনতে শুনতে রান্না, আলসেমি করে খাওয়া, আর দিনভর বসে শুয়ে কাটানো। আজকের প্ল্যান আপাতত এটুকুই।

শুরুতেই নিউটনের সুত্র বলেছিলাম না। এখন বোঝা গেল কেন বলেছিলাম? মনে হচ্ছে ওটা আমার উপর ও প্রয়োগ হয়েছে। বাইরে থেকে প্রযুক্ত বল দ্বারা বাধ্য না করলে আজ আর আমার অবস্থান এর কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।

রবিবার সবার ভাল কাটুক।
  

Tuesday, February 11, 2014

I am what I am

Time comes in life when you suddenly found that the way you live is being questioned.

 For example you have a certain pace/speed of moving in your life. Now the point is it doesn't match with anybody in the universe. And before you completely understand the situation you will be tagged as either "Slow" or "Fast".

Funny thing is, it is true that you are either faster than someone and or slower than someone. So the tag is not false. But the question is what will you do with that tag? You will be impressed or depressed? Difficult question. Interesting thing is that for the same pace you get two opposite tag. And more funny thing is if you change yourself thinking that it will solve the problem, tuning yourself in a different pace you notice that, that particular pace is also not matching with others. Still you are either faster or slower than others. 

He he.. you gave a great effort, changed yourself and still the result is same. And now you got a new tag "One who always change pace" Its a puzzle. There is no way out of it. Your pace is your pace. What you can do is what you can do. How you look to others are depend on the color of spectacle they are using. 

Is it not true that the universe look beautiful because we are different form each other? Is it not true that even we try we cannot be each other? 

Everybody born and grow up in different situation. The value of life we set in our life as a reference come from your experience which is different from each other. 

Is it not beautiful that everybody think differently? Is it not amazing that all the elements of this universe like sun, moon, planets, stars, galaxy being so unique form this universe. 

I am just a traveler in this endless time scale existing for a very short time. I have no time to decide what is good what is bad. I can just see things. I can enjoy. I can be happy.   
Sorry I have no time to be sad.

Thursday, December 12, 2013

ধান শীষ

হঠাৎ অনেক দিনের কথা মনে পড়ে গেল। সেটা কোন এক শীতের দিন। ধান কাটার দিন। আমার বয়স ছয় কি সাত। আমাদের একটা নুতন ট্রাক্টর কেনা হয়েছে। চাষ এর কাজে লাগে। লাঙ্গল দেওয়া, মাঠ থেকে ধান আনা। আমি তো খুশিতে উড়ছি। গরুর গাড়িতে চড়তে বেশ মজা। কিন্তু ট্র্যাক্টর আরও মজাদার। একজন ড্রাইভার রাখা হয়েছে। আমি তো সারাক্ষণ ড্রাইভার এর সাথে সাথে ঘুরি। 
আমি ড্রাইভার কে ড্রাইভারই বলতাম। এমন কি ড্রাইভারকাকুও নয়। শুধুই ড্রাইভার। ড্রাইভার ও আমাকে খুব ভালবাসত। যেখানেই যেত আমাকে নিয়ে যেত। মানে মাঠে ঘাটে আর কি।ট্রাক্টর নিয়ে আবার কোথায় যাবে। আমি সারাক্ষণ ড্রাইভার কে ক্ষেপিয়ে তুলতাম। আমাকে ট্রাক্টর চালান শেখাতে হবে। ড্রাইভার পড়ে মহা মুশকিলএ। কারণ ট্রাক্টর এর সিট এ বসলে আমার পা তখনো নিচে ব্রেক পর্যন্ত পৌছায় না। আমাকে মাঝে মাঝে স্টিয়ারিং এ বসিয়ে চালাত। ভারি মজা হত আমার।
ধান কাটার সময় সত্তি খুব মজার। সারা দিন ট্রাক্টর ব্যাস্ত থাকে মাঠ থেকে ধান আনতে। আর আমি সারাক্ষণ ট্রাক্টর এ। আর যখন জমি থেকে ধান ট্রাক্টর এ তোলা হচ্ছে আমি ধানের শিষ কুড়োতাম। ধান কাটার পর ধানের ডগার কিছু কিছু অংশ জমিতেই পড়ে থাকে। তাকে বলে ধানের শিষ। কেও সেই শিষ জমা করলে অনেক ধান পাওয়া যায় তার থেকে। কিন্তু ব্যস্ততার কারনে কেও সেটা সংগ্রহ করে না। আমার তো কাজ নেই। আমি ধানের শিষ কুড়তাম। আপন মনে।
আরও অনেক ছোট ছেলে জমা হত ধানের শিষ কুড়োবার জন্য। তারা একটু গরিব। সেই ধান সংগ্রহ করে ওরা দোকান এ বিক্রি করে চানাচুর কিনত। আমি ধানের শিষ কুড়িয়ে কিছুই করতাম না। সেটা আমার কাছে শুধুই মজা। সেই সব ছেলেদের সাথে প্রতিযোগিতা করতাম। কে বেশি শিষ কুড়তে পারে। হারতাম আমিই।
একসময় ট্রাক্টর এর ট্রলি ভরে যেত ধানে। ফিরে যাবার পালা। আমি ড্রাইভার এর কোলে। এমনি ভাবে সারাদিন ট্রাক্টর এ চেপে আর ধানের শিষ কুড়িয়ে কেটে যেত দিন। সন্ধ্যা বেলায় যখন লাল সূর্য ডুবছে পশ্চিম আকাশে আমি ক্লান্ত, অবসন্ন, সারা গায়ে ধুলোয় ভরা, ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে।

মনটা বড় উদাস হয়ে গেল। এই ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে। বড় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে সময়কে উলটো দিকে ঘুরিয়ে। অনেক দিন আগে লিখেছিলাম নিচের কবিতাটা। এখন খুব সত্যি মনে হচ্ছে

Wednesday, November 27, 2013

ই মেল

নিন্দুকে বলে সস্তা ডিজিটাল ক্যামেরা আর ফেসবুক আসার পর নাকি সবাই নিজেকে প্রফেসনাল ক্যামেরাম্যান ভাবতে শুরু করেছে। তা এই ব্লগ আসার পর সবাই নিজেকে লেখক ভাবতে সুরু করেছে কিনা নিন্দুকে সেরকম কিছু বলে নি। তবে হ্যাঁ, লিখতে বসলে নিজেকে লেখকই মনে হয়। আর বাঙ্গালিরা তো কোন এক "ঠাকুরের" আশীর্বাদে জন্ম লেখক। নোবেলটা যদিও এখনো ফিরে পাওয়া যায় নি। কিন্তু তাতে কি? তা ছাড়া সেই ছোটবেলায় যবে থেকে স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা চেয়েছিল তখন থেকেই যা খুশি লিখে লোকজনকে জোর করে শুনিয়ে অত্যাচার করার একটা ভাল অভ্যাস গঠন হয়েছে।
   তবে হ্যাঁ, সত্যি কথাই বলা ভাল। কোন লেখক হতে বা ভাল লেখার জন্য "ব্লগ" লিখতে বসি নি। আসল ঘটনাটা হল অনেক দিন থেকেই "ব্লগ" কথাটা শুনে একটু কৌতূহল হচ্ছিল যে "ব্লগ" কি জিনিস। খায় না মাথায় মাখে।

   কিছু দিন আগে শুনেছিলাম অমিতাভ বচ্চন নাকি "ব্লগ" করে। ভেবেছিলাম হয়তো কোন নূতন সিনেমা হবে হয়তো। পরে একদিন একটা প্রবন্ধ পড়লাম "ব্লগ কি সংবাদিকতার ভবিষ্যতকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলবে?" তখন থেকে ধীরে ধীরে একটা অনুভূতি হল যে "ব্লগ" আর যাই হোক কোন সিনেমার নাম নয়। এটা একটা যায়গা যেখানে নিজের কথা বলা যায়। তারপর ধীরে ধীরে পরিচয় হল "অর্কুট","ফেসবুক","টুইটার" আরও কত কিছুর সাথে। সত্যি কথা বলতে কি ভাল লাগল। কত সহজে পৌঁছে যাওয়া যায় সবার কাছে।
   ধীরে ধীরে আরও কত এল। বিভিন্ন ডিভাইস এর জন্য একদম স্পেসিফিক আপ্লিকেশন। কত সন্দেস প্রেরক (মেসেঞ্জার)। "জি-টক", "ফেসবুক ম্যানেজার" "ইয়াহু মেসেঞ্জার" (আমি এগুলোই ব্যবহার করি, মানে এগুলোতে আমার একাউন্ট আছে, তাই এগুলোই জানি)।  এ তো গেল কম্পিউটার এর জন্য। মোবাইল এর আবার "কাকাও টক", "কাকাও স্টোরি", "হোয়াটস অ্যাপ", "ভাইবার"। বাপরে। শেষই হয় না। মেসেঞ্জার এর লাইন পড়ে গেছে।
   এক সময় ছিল যখন মহান মেসেঞ্জাররা আসতেন। যেমন এসেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, যীশু, বুদ্ধ, মোহম্মদ, বিবেকানন্দ। এরা আসতেন আর মহান কিছু মেসেজ দিতেন। যাতে মানবজাতি অন্ধকারে রাস্তা খুঁজে পেত। আর এখন অনেক মেসেঞ্জার আছে কোন মহান মেসেজ নেই।
  ছাড় এসব গম্ভীর কথা। কি বলতে কি শুরু করেছি। আসলে কি বলছি আমি? এতক্ষনে বুঝতে পারছি আসলে আমি কিছু বলছি না। আমার কোন মেসেজই নেই। হাঃ হাঃ। 
  মনে পড়েছে। আমি আসলে বলছিলাম "ব্লগ" নিয়ে। এটা আমার প্রথম ব্লগিং। সে হিসাবে বেশ উত্তেজিত লাগছে। কেমন যেন নিজেকেও অমিতাভ বচ্চন লাগছে (ব্লগ শব্দটা আমি অমিতাভ বচ্চন এর সাথেই প্রথম শুনেছিলাম তাই)।
  আজ যখন শেষ মেষ ভেবেই বসলাম যে একটা কিছু লিখব তখন লেখার কোন টপিকই মাথায় আসছিল না।  আসলে আমার এই ব্লগ পর্যন্ত পৌঁছানোর ঘটনাটাও কিন্তু কম রোমহর্ষক নয়। আজকে সেটাই বলি। না ব্লগ অনেক লম্বা। আমার প্রথম ই মেল এর কাহিনি।

সে অনেক দিন আগের কথা। ২০০১। আমি হাইস্কুলে পড়ি। মেসে থাকি, পশ্চিমবঙ্গের এক মফস্বল শহর বর্ধমানএ। কম্পিউটার ও নেই আর মোবাইল ফোন ও নেই। নেই মানে চলন নেই। যতদূর মনে পড়ে ভারতবর্ষে সেটাই ননডিজিটাল যুগের শেষ আর আমজনতার জন্য ডিজিটাল যুগের শুরু। "এস এম এস", "চ্যাট্‌ "মেল" শব্দগুলোর সাথে তখনো ঠিক পরিচয় হয় নি। সম্ভবত তখন ও মোবাইলে ইনকামিং চার্জ লাগত। যাই হোক, বড় শহরে তখন সব্জির দোকান, সাইকেলের দোকান, মশলাপাতির দোকান এর সাথে সাথে আর একটা দোকান এরও বেশ প্রচলন হচ্ছে। " সাইবার ক্যাফে"।
 শুরুর দিকে ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্ম হত না। সত্যি কথা বলতে কি একটু ভয়ই লাগত। সাধারানত ক্যাফে গুলো একটু বেশ সাজানো গোছানো হত। কালো কাঁচের দরজা হত। আর ভেতরে এসি লাগান থাকত। কেতাদুরস্ত কেও কেও ভেতর থেকে বের হলে দরজাটা একটু যেটুকু খুলত তার ফাঁক দিয়ে দেখতাম ভেতরে ছোট ছোট প্লাইউড এর খুপরির মধ্যে সারি সারি কম্পিউটার। গ্রামের থেকে এসেছি। অন্তর থেকে একটা অনুভূতি হত যে পুরো ব্যাপারটাই ঠিক আমার জন্য নয়। 
  এভাবেই কেটে যাচ্ছিল বেশ। সাইবার আর ডিজিটাল দুনিয়া থেকে দূর আমার সেই শান্ত পৃথিবীর নিস্তরঙ্গ ঝিলে ঢিল মারল আমার এক দাদা। সুশীলদা।
 ছোট বেলা থেকেই সুশীলদা আমার খুব প্রিয়। আমাকে যেমন ভালবাসে তেমনি পড়াশুনাতেও বেশ ভাল। সেই সুশীলদাই আমাদের গ্রাম এর প্রথম ছেলে যে গ্রাম এর বাইরে অনেক দূর গিয়েছিল। মানে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিল। থাকতো ঘানায়। সেই আফ্রিকা। সদ্য চাঁদের পাহাড় পড়েছি। আফ্রিকা সম্পর্কে একটা শিহরণ আছে মনে। সুশীলদাকে আমার গল্পের "শঙ্কর" বলে মনে হত। একবার, তখন ক্লাস সিক্স এ পড়ি। হঠাৎ সুশীলদা আমাকে চিঠি লিখল ঘানা থেকে। আমার সারারাত ঘুম হয় নি। স্কুল আর হোস্টেল এর সব বন্ধুকে দেখিয়েছিলাম। অনেকে বিশ্বাস এ করতে চায় নি। কি যে আনন্দ হয়েছিল কি বলব। 
  সেই সুশীলদাই একবার বাড়ি এল। যাবার আগে দিয়ে গেল তার কার্ড। ভিসিটিং কার্ড। তাতে নাম ঠিকানা পদমর্যাদা, ফোন নম্বর এর সাথে সাথে আর একটা লাইন ছিল যেটা হয়ত আমার নজর এড়িয়ে যেত যদি না আগে অর্ঘ তাঁর আমেরিকার মামাকে কিভাবে এক সেকেন্ডে কম্পিউটার এর মাধ্যমে চিঠি পাঠায় সে গল্প ফলাও করে না বলত (প্রসঙ্গত,সে অর্ঘও এখন আমেরিকায় থাকে)। সেটা আজকের দুনিয়ায় সবার জানা। একটা ইমেল আইডি। হঠাৎ মগজে খেলে গেল আরে আমিও তো সুদুর ঘানায় চিঠি পাঠাতে পারি এক সেকেন্ডে। ব্যাস যেমন ভাবনা তেমন কাজ।
  সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা সাইবার ক্যাফেতে। কারন ক্যাফের দরজায় দেখতাম লেখা আছে "ই মেল"। ভেবেছিলাম এটাও চিঠি পাঠাবার মত কোন ব্যাপার। বা বড় জোর ফোন করার মত। পকেটে টাকা বেশি নেই। তাই ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলাম ইমেল পাঠাতে কত টাকা লাগে? উত্তরটা শুনে ঠিক বোধগম্য হয় নি প্রথমে। "এক ঘন্টায় তিরিশ টাকা।" ভাবলাম এ তো বেশ সস্তা। কারন আমার তো এক সেকেন্ডই লাগবে। কোন মতেই হিসাব করতে পারছিলাম না এক ঘন্টায় তিরিশ টাকা লাগলে এক সেকেন্ডে কত টাকা লাগতে পারে?
  যাই হোক অনেক সাহস নিয়ে বললাম আমি একটা ইমেল করব। সে বলল কর। আমি তো অবাক। আমি তো কিছুই জানি না। আমি করব কি ভাবে? লেখা লিখির জন্য তো একটা কাগজ বা খাম বা কিছু একটা দেবে না কি? আমি লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম "দেখুন আমি ঠিক জানি না। আমাকে একটু সাহায্য করুন।" তারপর দাদার ভিসিটিং কার্ডটা দেখালাম যেখানে মেল আইডিটা লেখা আছে।  সে কম্পিউটারটা দেখিয়ে বলল ওখানে বোস, আসছি।

   কিছুক্ষন পর এসে কি সব ক্লিক করল এখানে ওখানে, তারপর জিজ্ঞাসা করল তোমার মেল আইডি কি? আমার তো হাসার জোগাড়। আমার আবার মেল আইডি কি? সেসব তো বড় বড় লোকের থাকে। আসলে আমি মেল আইডি কথাটার মানেই ঠিক বুঝি নি তখন।
  আমার সরল জবাব "আমার তো কোন আইডি নেই। আইডি করতে গেলে কি করতে হবে?" সে বলল " একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে, তার জন্য একটা ফর্ম ফিল আপ করতে হবে"। এর আগে আমি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়া আর কোন অ্যাকাউন্ট এর কথা শুনিনি ।  আমি তখন মরিয়া। যা করার করব। কিন্তু মেল আমাকে পাঠাতেই হবে।
   আমি জিজ্ঞাসা করলাম ফর্ম ফিল আপ করতে কত টাকা লাগবে? সে বলল "ফ্রি"। বললাম দিন ফর্ম। লোকটার সেই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিটা আমার এখনও মনে আছে।
   আমি একটু কুঁকড়ে গেলাম। বুঝলাম ভুল যায়গায় চলে এসেছি। যাই হোক, সে একটা ফর্ম কম্পিউটার এর পর্দায় বের করে দিয়ে বলল এটা ফিল আপ কর আমি আসছি। বলে চলে গেল। আসলে তার জেরক্স এর দোকানও ছিল। আর সেখানেই তাকে বেশি সময় দিতে হত। আমি তো কিংকর্তব্যবিমুঢ হয়ে রইলাম।
    আমার পাশের কম্পিউটার এ একজন বসেছিলেন। আমার অবস্থা দেখে একটু দয়া হল মনে হয়। সে আমাকে এক এক করে দেখিয়ে দিল কি করে কি-বোর্ডে টাইপ করে লিখতে হয়।
    জানার আনন্দে বিভোর হয়ে আমি ফর্ম পূরণ করে চলেছি। প্রায় শেষ হব হব হয়েছে, এমন সময় একটা কোলাহল কানে এল। একজন ক্যাফের লোকটাকে বলছে "আরে দাদা মেল তো সেন্ডই হচ্ছে না। আপনার ইন্টারনেটই খারাপ। কোন কানেকসানই নেই। আমি টাকা দেব না।"  
      আমি তো অবাক। এ কি বলে? যাই হোক আমি নিজের চরখায় তেল দিলাম। কিন্তু সাথে সাথে ক্যাফের লোকটা আমাকে বলল "আজ হবে না, ইন্টারনেট কানেকসানএ গোলমাল আছে।" যা ব্বাবা। মানে আমার মেল পাঠান হবে না? বেশ হতাশ হলাম। কিন্তু ততক্ষনে আমি বুঝে গেছি (আমি খুব বুদ্ধিমান) যে এক ঘন্টায় তিরিশ টাকা মানেটা কি !! যাই হোক মন খারাপ করে বেরিয়ে এলাম। তবে হ্যাঁ লোকটা ১০টাকাই নিল, ইন্টারনেট ছিল না এতক্ষন !! 
  বাইরে বের হয়ে আমি ফিরে এলাম আমার দুনিয়ায়। তবে হ্যাঁ এতো সহজে আমি হাল ছাড়তে রাজি নই। 
দিন দুই বাদ আবার গেলাম। তবে এবার অন্য ক্যাফেতে। একটু ফাঁকা ফাঁকা। গিয়েই সরাসরি বললাম "দেখুন দাদা, আমাকে একটা মেল করতে হবে, কিন্তু আমি মেল করতে জানি না আর আমার মেল আইডিও নেই, আপনাকে সাহায্য করতে হবে"।
 এক নিঃশ্বাসএ বলে ফেললাম। ছেলেটা বেশ ভাল ছিল। বলল কোন ব্যাপার নয়। এসো। সেই সব করে দিল। শুধু লিখলাম আমি।
   সে এক অন্য অনুভূতি। আমার মন তখন ঘানায়। আসলে ঘানায় নয়। আফ্রিকায়। চাঁদের পাহাড়ে। সেই শঙ্কর, সেই আলভারেজ, সেই বাওয়াব গাছ, সেই সিংহ, সেই তিন আঙ্গুল ওয়ালা বুনিপ। কি কি যে লিখেছিলাম মনে নেই। কিন্তু খুব আদর ছিল সেই চিঠিতে। চিঠি তো নয়। আমার আবেগ, আমার সমস্ত কল্পনা, সমস্ত উত্তেজনা একাকার ছিল সেই "মেল" এ। হুঁশ ফিরল যখন সেই ছেলেটা বলল একটু তাড়াতাড়ি কর, এক ঘণ্টা হতে চলল। আমি আফ্রিকা ছেড়ে বর্ধমান এ ফিরে এলাম। "সেন্ড"-কি টা টেপার সাথে সাথে মেল গেল সাত সমুদ্র তের নদীর পার এ।
    টাকা মিটিয়ে যখন বাইরে এলাম তখনো আমি স্বপ্নের মধ্যে। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। প্রথম মেল করার উত্তেজনা তখন আমার শিরায় শিরায়। হৃৎপিণ্ড যেন রক্তকে অনেক জোরে জোরে পাম্প করছে। সাইকেল নিয়ে ঘুরলাম অনেকক্ষণ। আজ শহরের আলোগুলো কেন জানি না চোখে পড়ছে না। কোলাহল কানে আসছে না। আর কোন রাস্তা দিয়ে যে যাচ্ছি সেটা তো কোন খেয়ালই নেই। কোথায় বর্ধমান আর কোথায় আফ্রিকা !! আমি বর্ধমান নয় আফ্রিকার জঙ্গল এ ঘুরছি। না জানি দাদা কখন আমার মেল পড়বে। পড়ে কখন উত্তর দেবে। 
    পরের দিন আমি গেলাম আবার সেই ক্যাফেতে। জিজ্ঞেস করতে উত্তর এসেছে কি না। সেই ছেলেটা আবার মেল খুলল। খুলে বলল আমার মেলটা নাকি যায় নি। মেল আইডিটা নাকি ভুল। বা তার কোন অস্থিত্ত নেই। খুবই দুঃখ হয়েছিল সেদিন।  কি আর করব? নিজেকে সান্তনা দিলাম চেষ্টা তো করেছিলাম।
  তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। প্রায় ২ বছর। আমি কলেজে পড়ি। বর্ধমান ছেড়ে এসেছি বাঁকুড়া। এর মধ্যে দাদা আমাদের বাড়িতে ফোন করেছে বেশ কয়েকবার। আর আমি ইতিমধ্যেই জানিয়েছি যে আমি মেল পাঠিয়েছিলাম কিন্তু পৌঁছায়নি। দাদা অন্য একটা মেল আইডি দিল আমায়।
  আর একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি কম্পিউটার ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। আর ততদিন এ কম্পিউটার এর প্রাথমিক বিষয়গুলো জানা হয়ে গেছে। এবার একটু সাহস নিয়ে গেলাম একটা ক্যাফেতে। কিন্তু দু তিন বার ঘুরে আসতে হল। পারলাম না মেল পাঠাতে। প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মন বলল আর একবার চেষ্টা করি। প্রতিবারই কিছু না কিছু একটা গোলমাল হয়। হয় আইডি ঠিকঠাক তৈরি হয় না, নয় তো আইডি তৈরি করার পরই তার পাসওয়ার্ড ভুলে যাই। সে এক গোলমাল সময়।
   শেষ পর্যন্ত একদিন সফল ভাবে পাঠালাম একটা মেল। আর উত্তর ও পেলাম কদিনের মধ্যে। আজও সে অনুভুতি আমার হৃদয়ে "সেভ" করা আছে।
  আমার মনে হয় গিনিস বুকএ একটা রেকর্ড  করে ফেলেছি। একটা মেল পাঠাতে দীর্ঘতম সময়। তিন বছর। আর কত টাকা যে গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই সাথে কত অপমান। কে যে বলেছিল মেল পাঠাতে নাকি এক সেকেন্ড সময় লাগে !!!

*** পুনশ্চ : কলেজ শেষে একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা কলাম ছিল "মেল আইডি" আর আমি সেটা গর্ব ভরে লিখেছিলাম। অবশেষে কাজে লাগল আমার মেল আইডি। অনেক বন্ধুর মেল আইডি ছিল না। তারা আমাকে দেখে অবাক। আমার কি করে মেল আইডি আছে। অল্প সময়ে সে গল্প বলে উঠতে পারি নি ওদের। কিন্তু ওদের সেই আশ্চর্য ভরা চাহনি আমার সমস্ত কষ্ট সুদে আসলে ফিরিয়ে দিয়েছিল পরিতৃপ্তি রূপে।