Monday, May 21, 2018

স্বপ্নপুরণ

স্বপ্নপুরণ

ওই যে দূরে পাহাড়ের কোলে রাজা বসে আছেন তার নাম রাজা সেজং। উনি ১৪১৮ সাল থেকে ১৪৫০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন কোরিয়াতে। অনেক ভাল কাজ করেছিলেন। যার মধ্যে সবচে উল্লেখযোগ্য হল কোরিয়ান ভাষার প্রচলন। আগে কোরিয়াতে চীনা হরফে লেখা হত। যা ছিল জটিল। তা থেকে উনি কোরিয়ান ভাষার ব্যবহার শুরু করেন যার লিখিত রূপ সাধারণ মানুষের জীবনকে নিঃসন্দেহে অনেক সহজ করে দিয়েছিল। কোরিয়ান ভাষার লিখিত রূপ এতোটাই সোজা যে ইচ্ছা থাকলে দুই ঘন্টার মধ্যে শিখে যাওয়া যায়।
এই রকম একজন মহান মানুষকে শ্রধ্যা জানাতে কোরিয়ার মানুষ তাঁরই রাজপ্রসাদের সামনে তাঁর দুটি মূর্তি স্থাপন করে। এই যায়গাটি দেশ বিদেশের অসংখ মানুষ প্রতি বছর ভ্রমন করেন। কোরিয়া বিশেষ করে সোল ঘুরেছেন অথচ সেজং রাজার প্রাসাদ অ এনার মুর্তি দেখেন নি এমন মানুষ কম আছেন। এনাকে স্মরণীয় করে তুলতে কোরিয়ান নোটেও এনার ছবি ছাপা হয়েছে।
যাই হোক অনেক মানুষের মত আমিও ভ্রমণ করেছিলাম এই যায়গাটি। প্রথম যখন এখানে আসি তখন ২০১০ সাল। এক কোরিয়ান বন্ধু আমাকে এখানে নিয়ে আসে। রাজার মূর্তি, রাজপ্রাসাদ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পিছনে বুকখানসান পর্বতের একটি চূড়া অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে উদাত্ত্ব ভঙ্গিতে গর্বভরে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাস যেন এখানে থেমে আছে। তার সামনে কোরিয়ার সময়ের সাথে পা মিলিয়ে চলার সাক্ষী গগনচুম্বী অট্টালিকা। নয়ন জুড়ানো। অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের এভাবে একসাথে একই স্থানে সহাবস্থানের নজির বিশ্বে খুব কম দেখা যায়।
যাই হোক, ইতিহাস ভূগোল, সমৃদ্ধি ছাড়াও যে জিনিসটা আমাকে সবচে বেশি আকর্ষণ করেছিল তা হল রাজা সেজং এর দাঁড়ানো মুর্তির পাদদেশে সজ্জিত শখানেক জলের ফোয়ারা। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এগুলো চালু থাকে। এই ফোয়ারা গুলি এই যায়গার সৌন্দর্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সবচে বড় কথা হল এগুলির চারপাশে কোন বেড়া দেওয়া নেই। যে কেও এগুলি ছুঁয়ে দেখতে পারে। গ্রীষ্মকালে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা এখানে খেলা করে। জলে ভেজে। অনাবিল আনন্দের উৎস। প্রথম যখন দেখেছিলাম সমস্ত লজ্জা ছুঁড়ে ফেলে জলের ফোয়ারাতে খেলতে ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু সেখানে সবাই খুব কম বয়সের ছেলেমেয়ে খেলা করছিল। তাই আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গিয়েছিল। সেদিন ঠিক করেছিলাম এক দিন না এক দিন এখানে এসে আমার ছেলে বা মেয়ের সাথে এখানে খেলব। তখন আর কেও আমাকে না বলতে পারবে না।
আজ ২০১৮ সালে এসে আট বছর পর পুরণ হল আমার স্বপ্ন। একা যে স্বপ্ন স্পর্শ করা যায় না অনেক সময় পরিবার পুরণ করে সে সব। পুত্র নিয়ন প্রায় দশ মাস ছুঁই ছুঁই। এখনো দাঁড়াতে শেখে নি। আনমনে থাকলে এক দু মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। একটা কাজে গিয়েছিলাম রাজপ্রাসাদ এর কাছে। কাজের পর ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করা যাক এই দিকটা। ঠান্ডা এখনো পুরপুরি যায় নি। তবুও এখানে এসে মনটা আনচান করে উঠল ফোয়ারা দেখে। স্বপ্নের এত কাছাকাছি এসে আর অপেক্ষা সইল না। কবে গরম পড়বে আর কবে নিয়ন হাঁটতে শিখবে। সমস্ত ভুলে বাপ বেটায় চলে গেলাম ফোয়ারার মাঝে। শীতল জল স্পর্শ করলাম। যাদুবলে নিয়নও দাঁড়িয়ে পড়ল। নিয়ন জল খুব ভালবাসে। সেও আনন্দে চিৎকার করছিল। ঘরে কলে জল পড়লে সবসময় তাতে ভিজতে চায়। আজ জলের সাথে খেলল প্রাণ ভরে। স্বচ্ছ স্ফটিকের মত জল। দুলকি চালে নিয়নের উচ্চতাতেই ওঠে আর নিচে নামে। নাচ করে। বেশ কিছুক্ষণ কাটল এভাবে। প্রাণ শীতল হল। জীবন জুড়িয়ে গেল।
এই আনন্দসুন্দর মুহুর্তগুলি স্মৃতির খাতায় জমা করতে ক্রুতির উৎসাহের অভাব ছিল না। তারই কিছু ভাগ করে নিলাম সবার সাথে।
গাড়ি, বাড়ি, পেশার চিন্তার বাইরে এমন অনেক ছোট ছোট স্বপ্নই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। সাফল্যের আশ্বাস দিয়ে যায়। মনকে সবুজ রাখে। সুন্দর রাখে চারপাশ। অনাবিল আনন্দে পুর্ণ করে জীবন। একটাই আশা - এই মনে যেন চিরবসন্ত বিরাজ করে।

No comments:

Post a Comment